হাফেজ মৌলানা ক্বারী মোহাম্মদ তৈয়ব জালাল
শব এটি একটি ফার্সী শব্দ, যার অর্থ রাত। বারাত অর্থ ফার্সীতে নিলে হবে ভাগ্য। মূলত ফার্সী দিয়েই শবে বরাতের প্রচলন। আর আরবীতে লাইলুন অর্থ রাত, বারাআহ অর্থ মুক্তি, অব্যাহতি, দায়মুক্তি ইত্যাদী। যেমন সূরা তাওবার শুরুতে মহান আল্লাহ তায়াআলা বলেছেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) এর পক্ষ থেকে ঐ সব মুশরিকদের প্রতি অব্যাহতি, যারা তোমাদের সাথে চুক্তি করেছিল সূরা তাওবা ১। অন্য আয়াতে তিনি আরও বলেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) এর পক্ষ থেকে আজ মহান হজ্জের দিনে মানুষের প্রতি ঘোষণা যে, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তি- সূরা তাওবা ৩। অন্য আয়াতে তিনি আরও বলেন- আর যখন ইব্রাহীম (আ) তাঁর পিতা ও তাঁর জাতিকে বলল, তোমরা যার ইবাদাত কর, তা থেকে নিশ্চয়ই আমি মুক্ত- সূরা যুখরুফ ২৬।

কুরআন ও হাদীসে কোথাও শবে বারাত শব্দটি আসেনি। আগে ফার্সী পরে আরবী মিশিয়ে কুরআন ও হাদীসের কোথাও কোন শব্দ আসেনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আপনারা দেখবেন, ফার্সীর মহামারিতে ভারত উপমহাদেশের প্রায় অঞ্চল থেকে আরবী নামগুলো একেবারেই উধাও হয়ে গেছে। সালাতের নাম নামায, সিয়ামের নাম রোযা, জান্নাতের নাম বেহেস্ত, জাহান্নামের নাম দোযখ, আল্লাহ’র নাম খোদা ইত্যাদীতে রূপান্ত্রিত হয়ে গেছে। মূলত শিয়াপ্রভাবিত শাসকদের খাম খেয়ালী ও তৎকালীন দরবারী আলেমদের কারণেই এমনটা হয়েছে। আর ইবাদাতের মাঝে যত বানোয়াট কিছু প্রবেশ করেছে, তার অন্যতম কারণই এটিই। যেমন আমাদের মধ্যে যারা ঐসব রাত উদযাপন করতে গিয়ে সালাত আদায় করেন, তাদের অনেকে প্রথম সূরা ফাতিহা এতবার, অমুক সূরা এতবার, সবই তাদের কিতাব থেকে এসেছে, শুধু বরাতের নামায নয়, এভাবে কুরআন ও সুন্নাহ বিবর্জিত বহু আমল পাওয়া যাবে- ইকবালুল আ’মাল- ইবনে তাউস আল হুসাইনী,www.alseraj.net (আরবী নাম: শাবকাতুশ শীআ আল আলামিয়া)।

তাহলে আসল কিভাবে:
মূলত যত বেদাতের আবিস্কার হয়েছে, তার অধিকাংশ ইরাক, ইরান ও তৎকালীন তুরস্ক থেকে এসেছে। যার কারণে নামটাও হয়েছে ফার্সীতে। আমলের এ সব পদ্ধতিও পাওয়া যাবে শিয়াদের রচিত বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও গ্রন্থাদিতে। শুধু শবে বরাত কেন, এভাবে কুরআন ও সুন্নাহ বিবর্জিত যতসব ইবাদাত ও পদ্ধতি পাওয়া যাবে, তার সিংহভাগ পাবেন তাদের বই সমূহে। শুধু আমল নয়, আকিদাগত বিভ্রান্তির মূলেও তাদের অবদান। বিস্তারিত জানতে তাদেরই রচিত গ্রন্থ- আল ইহতিজাজ, শাহেদুন নুবুয়াহ, আল কাফী, উসূলু কাফীসহ ইকবালুল আ’মাল – ইবনে তাউস আল হুসাইনীর বইয়ে দেখুন,www.alseraj.net (আরবী নাম: শাবকাতুশ শীআ আল আলামিয়া)।

হাদীসের কিছু কিছু কিতাবে বর্ণিত “লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান”কে অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদকরা শবে বরাত নামকরণ করেছেন। আর ঐ রাতকে নিয়েই উপমহাদেশে কতগরু মুরগি ও হালুয়া এবং বেদাতী আমলের প্রচলন। আসলে ঐ রাতের ব্যাপারে যত সব হাদীস এসেছে, তার একটি ছাড়া সবই বানোয়াট ও দুর্বল। যা পরে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা হবে ইন শা আল্লাহ। আগে আমরা আলোচনা করব, কুরআনের যে আয়াত দিয়ে শবে বরাতের দলীল দেন তা নিয়ে।

সূরা দোখানের ৩নং আয়াতের ব্যাখা করতে গিয়ে অনেক ইমামগণ নিজের অজ্ঞতাবশত ১ ও ২নং আয়াত এবং সূরা কদর আর সূরা বাকার ১৮৫নং আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক করে উপস্থাপন করে।

সূরা দোখানের ৩নং আয়াতে লাইলাতুন মুবারাকা শব্দের অর্থ তারা শবে বরাত করে থাকেন।

প্রিয় পাঠক, চলুন, পর্যালোচনা করি
হামীম- সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। নিশ্চয় আমি তাকে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। যে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্বীকৃত হয়- সূরা দোখান ১-৪। ঐ আয়াতগুলোর স্বাক্ষ্য হিসেবে রয়েছে, সূরা বাকারার ১৮৫নং আয়াত, যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রামাদান মাস, যাতে এমন কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত। তেমনিভাবে সূরা কদর, যেখানে বর্ণিত হয়েছে, আমি একে (কুরআন) লাইলাতুল কদরের রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন কদর রজনী কি? যে রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সে রাতে প্রত্যেক কাজের ফেরেস্তারা ও রূহ অবতরণ করেন তাদের রবের অনুমতিক্রমে। এই শান্তি (নিরাপত্তা) ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত থাকে- সূরা কদর ১-৫।

ঐ বিষয়ে আমরা সকলে জানি ও শুনি, এমনকি রামাদান মাসের জুমাগুলোতে প্রায় খতীব সাহেব মহোদয়গণ বলেন যে, রামাদান মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আর তা হয়েছে কদরের রাতে।

ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা:
যারা অপব্যাখ্যা করে লাইলাতুন মুবারাকা বলে শবে বরাত নেন, তারা সূরা দোখানের ১নং আয়াতকে ২নং আয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করে উপস্থাপন করেন। ফলে তাদের দাবীর পক্ষে দলীল হয়ে যায়। অথচ উক্ত দুই আয়াতকে বিচ্ছিন্ন করার কোন সুযোগ নেই। কারণ ২নং আয়াতে কিতাব ও ৩নং আয়াতের হু (তাকে, যাকে) নামক সর্বনামটি এক ও অভিন্ন। তাদের এহেন ব্যাখ্যার কারণে কুরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের পরস্পর বিরোধী হয়ে দাড়ায়। যা কখনো উচিত নয়।

আর যারা সঠিক ব্যাখ্যা করে লাইলাতুন মুবারাকা বলে লাইলাতুল কদর নেন, তারা সূরা দোখানের ১নং আয়াতকে ২নং আয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন না করেই উপস্থাপন করেন। ফলে তাদের দাবীর পক্ষে দলীল হয়ে যায়। তারা বলে, উক্ত দুই আয়াতকে বিচ্ছিন্ন করার কোন সুযোগ নেই। কারণ ২নং আয়াতে কিতাব ও ৩নং আয়াতের হু (তাকে, যাকে) নামক সর্বনামটি এক ও অভিন্ন। আর উক্ত আয়াতের পক্ষে রয়েছে বহু আয়াত।

এবার আমরা দেখব, বিভিন্ন তাফসীরের গ্রন্থকারগণ, লাইলাতুন মুবারাকার তাফসীর কি করেছেন:
১. তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৪নং খন্ডের ৪৬৯নং পৃষ্ঠায় সূরা দোখানের ৩ ও ৪নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুজাহিদ (র) সূত্রে মানছুর (র) বর্ণনা করেন- লাইলাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর। কারণ এই রাতেই পূর্ণ বছরের রিযিক, আপদবিপদ নির্ধারিত হয়।

২. তাফসীরে কুরতুবী: ২নং খন্ডের ২৯৭নং তিনি বলেছেন, লাইলাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর, কারণ লাইলাতুল কদর রামাদানের বাইরে হয়না। আর লাওহে মাহফুজ থেকে রামাদানের বাইরে কুরআন নাযিল হওয়া লাইলাতুল কদরের বিপরীত।
৩. তাফসীরে তাবারী: ১৬নং খন্ডের ৪৮০নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৪. তাফসীরে মা’আনিল কুরআন: ৪নং খন্ডের ৪২৩নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৫. তাফসীরে ইবনে আবী খাতিম: ১নং খন্ডের ৩১১নং পৃষ্ঠার ১৬৫১নং বর্ণনায় ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এসেছে, লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৬. তাফসীরে সামার কান্দী (বাহরুল উলুম): ৩নং খন্ডের ২৬৭নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৭. তাফসীরে ছা’লবী (আল কাশফ ওয়াল বয়ান): ৮নং খন্ডের ৩৪৯নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৮. তাফসীরে আল হিদায়া ইলা বুলূগুননিহায়া: ১০নং খন্ডের ৬৭১৯নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
৯. তাফসীরে মাওয়ারদী (আন নুকত ওয়াল উয়ূন): ৫নং খন্ডের ২৪৫নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর। তিনি এখানে কতগুলো কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, কদরের রাতে যেহেতু রহমত ও বরকত নাযিল হয়, তাই লাইলাতুন মুবারাকা মানেই লাইলাতুল কদর। এবং ঐ দিনেই তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও ইব্রাহীম (আ)এর সহীফা নাযিল হয়।
১০. তাফসীরে লাতাইফুল ইশারাত: ৩নং খন্ডের ৩৭৯নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
১১. তাফসীরুল ওয়াসীত: ১নং খন্ডের ২৮১নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
১২. তাফসীরে রাগেব: ১নং খন্ডের ৩৯২নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
১৩. তাফসীরে গারায়েব: ১নং খন্ডের ১৯৮নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
১৪. তাফসীরে বাগাবী: ১নং খন্ডের ২১৬নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।
১৫. তাফসীরে ঈজাযুল বায়ান: ২নং খন্ডের ৭৪১নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর।

১৬. তাফসীরে রাজী: ২৭নং খন্ডের ৬৫২নং পৃষ্ঠায় এসেছে লায়লাতুন মুবারাকা মানে লাইলাতুল কদর। তিনি আরও বলেছেন, ইকরামাসহ যারা শাবানের অর্ধরাত্রি নিয়েছেন, তাদের পক্ষে বিশুদ্ধ কোন দলীল নেই।
১৭. তাফসীরে যাদুল মুইয়াস্সার: ৪নং খন্ডের ৮৭নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে, যে সকল তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুন মুবারাকা বলে লাইলাতুন নিসফ মিন শা’বান বলা হয়েছে, তার সবই ইকরামা (র) থেকে বর্ণনা করেছেন। আর সেই বর্ণনা পরস্পর বিরোধী।

আতিয়্যা বিন আসওয়াদ (র) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা)কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছি। আবার তিনি বলেছেন, আমি কদরের রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি। আবার বলেছেন, আমি বরকতময় রাতে কুরআন নাযিল করেছি। অথচ কুরআন নাযিল হচ্ছে রামাদানে, শাওয়ালে, যিলকদে, মুহাররমে ও রবিউল আওয়াল ও রবিউস্সানীতে। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা রামাদানে কদরের রজীতে বরকতময় রাতে একত্রে কুরআন নাযিল করেন- কিয়ামে রামাদান মুহাম্মদ বিন নাসর ১খন্ড ২৪৯পৃ। তেমনি ভাবে মুসতাদরাক হাকিমের ২নং খন্ডের ৪৮৭পৃষ্ঠায় সহীহ হাদীসেও লাইলাতুন মুবারাকাতুন মানে লাইলাতুল কদর বলা হয়েছে।

উপরোক্ত হাদীসেও লাইলাতুন মুবারাকা বলতে লাইলাতুল কদরকে বুঝিয়েছেন।

মোট কথা কোন তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থে সূরা দোখানের ঐ সকল আয়াত দিয়ে লাইলাতুল বারাত বুঝাননি। বরং কিছু কিছু তাফসীর গ্রন্থকার ঐ বর্ণনাটি আনার পর দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছেন।

অতএব উপরে উল্লেখিত বর্ণনাগুলো মতে সূরা দোখানের ৩নং আয়াতে বর্ণিত লাইলাতুন মুবারাক বলতে মূলত লাইলাতুল কদর। আর যে সকল তাফসীর বিশারদগণ লাইলাতুল বারাআহ নিয়েছেন, তারাও পর্যালোচনা করে তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছেন।

তাহলে ঐ রজনীর আসল নাম কি?

কুরআনের কোন আয়াত দ্বারা ঐ রাত প্রমাণিত নয়। বরং হাদীসের দ্বারাই ঐ রাত প্রমাণিত। আর তার আসল নাম হচ্ছে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান তথা শা’বানের মধ্য রাত্রী-।

শা’বানের মধ্য রাত্রী সম্পর্কিত হাদীসগুলোর পর্যালোচনা:

হযরত আয়েশা (রা) রাসূল (স)কে বাকী কবর স্থানে পাওয়ার একটি হাদীস আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত ও প্রচলিত। অথচ হাদীসটি বর্ণনা করার পর ইমাম তিরমিজী (র)এর মূল্যায়ণটি আমরা উল্লেখ করতে চাইনা। তিনি বলেছেন, আয়েশার হাদীসটি আমি হাজ্জাজ নামক রাবীর সূত্রেই পেয়েছি। ইমাম বুখারী ঐ হাদীসকে দুর্বল বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইয়াহিয়া ইবনে কাসীর উরওয়া থেকে হাদীস শুনেনি, আর হাজ্জাজ বিন আরতা ইয়াহিয়া ইবনে কাসীর থেকে হাদীস শুনেনি- তিরমিজী ৭৩৯।

আর আলী (রা)এর সূত্রেও একটি হাদীস বহুল প্রচারিত ও প্রচলিত, যা মসজিদের খতীবগণ খোৎবাতুল আহকামসহ প্রচলিত অন্যান্য খোৎবার কিতাব থেকে বর্ণনা করে থাকেন। ঐ হাদীসে শা’বান মাসের মধ্য রজনীতে তোমরা দিনে রোযা রাখ, রাতে সালাত আদায় কর, কেননা আল্লাহ পৃথিবী সংলগ্ন আকাশে নেমে আসেন, আর বলেন কে আছ ক্ষমা চাওয়ার? কে আছ রিযিক চাওয়ার? কে আছ বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়ার? ইত্যাদী ইত্যাদী- ইবনে মাজাহ ১৩৮৮।

হাদীসটি যে বানোয়াট, তার একটি প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা শুধু ঐ রাতেই আকাশে নামেন না, বরং প্রতিটি রাতেরই শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সংলগ্ন আকাশে নেমে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন- সহীহ মুসলিম ৭৫৮। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ঐ হাদীসের সদন (চেইন)এ এমন কতগুলো বর্ণনাকারী রয়েছেন, যাদেরকে বিভিন্ন হাদীসশাস্ত্রগণ দুর্বল বলেছেন- সিলসিলা যঈফা ২১৩২।

অনেক ভাইয়েরা আবার প্রশ্ন করবেন, হাদীস কিভাবে বানোয়াট হতে পারে? তার উত্তর আমাদের সকলেরই জেনে রাখা উচিত, নবী যদি ভন্ড হয়, তার হাদীস কিভাবে সহীহ হবে? তেমনিভাবে অসংখ্য রাবীগণ নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য বড় মাপের রাবীদের বরাত দিয়ে মনগড়া হাদীস বর্ণনা করত, এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (র) রচিত “হাদীসের নামে জালিয়াতি” বইটি পড়লে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আবু মুশা আশারী (রা) রাসূল (স) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্য রজনীতে মুশরিক ও মুশাহিন ছাড়া সকলকে ক্ষমা দেন- ইবনে মাজাহ ১৩৯০।

উক্ত হাদীসকে ইমাম আলবানী (রা) হাসান বলেছেন। তবে অনেকে এটিকে যঈফও বলেছেন। কারণ এখানে আব্দুল্লাহ বিন লাহিয়াহ দুর্বল রাবি- বায়ানুল ওয়াহম ২৬৪।

উক্ত হাদীস অনুযায়ী মুশরিক ও মুশাহিন ছাড়া সকলেই ক্ষমা পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমা পাওয়ার জন্য কি ইবাদাত শর্ত? নাকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দিবেন?

মূলত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দিবেন। যেভাবে রামাদান মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বহু জাহান্নামীকে ক্ষমা করে দেন- ইবনে হিব্বান ৩৪৩৫।

সুতরাং যে সকল মুসলিম উপরোক্ত দুই দোষ থেকে বিরত থাকবে, সে সকল মুসলিমগণ অবশ্যই আল্লাহপ্রদত্ত ঐ ক্ষমা পাবে। চাইলে সে ঘুমিয়ে থাকুক বা জাগ্রত থাকুক।

ঐ হাদীসকে ইস্যু বানিয়ে ঐ রাতকে নির্দিষ্ট করে যেকোন ইবাদাত করা হউক না কেন, সবই বিদাত তথা পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হবে। হ্যাঁ প্রতি চন্দ্র মাসের মধ্যবর্তী দিনগুলোতে যে রাসূল (স) তিনটি রোযা রাখতেন, সে হিসেবে কোন ব্যক্তি যদি শা’বান মাসের মধ্যবর্তী দিনগুলোতে সিয়াম পালন করে থাকেন, তাহলে সে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার কারণে অবশ্যই ছওয়াব পাবে। তেমনিভাবে কোন ব্যক্তির রাত্রী ইবাদাতের অভ্যাস থাকে, তবে সে যদি তার অংশ হিসেবে ঐ রাতেও ইবাদাত করে, তাহলে দোষের কিছু নেই।

মূলত বিদাত হচ্ছে ঐ সকল লোকদের জন্য, যারা শুধু মাত্র ঐ রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদাত করে, ঐ দিনকে নির্দিষ্ট করে সিয়াম পালন করেন। অন্যান্য দিনের ফরজ ইবাদাতেরও কোন খবর রাখেন না। তেমনিভাবে ঐ দিনে ছওয়াবের আশায় বিশেষ খাবারের আয়োজন করাও বিদাত। কারণ; ইসলামের স্বর্ণলী যুগ থেকে আজপর্যন্ত ইসলামের কেন্দ্রস্থল বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববীতে ঐ সব দিবস পালন করেন না। তেমনিভাবে ঐ রাত বা দিনকে উপলক্ষ করে কবর যিয়ারত করতে যাওয়া, কবরস্থান ঘেরাও করা একটি বেদাত। কবরস্থান আলোকিতকারী ও সিজদাকারী আর মহিলা কবর যিয়ারতকারীণীকে রাসূল (স) অভিশম্পাত করেছেন- আবু দাউদ ৩২৩৬।

ঐ রাত উপলক্ষে আমাদের দেশে কতিপয় মসজিদে বিশেষ পদ্ধতিতে কতগুলো নামাজ আদায় করা হয়, হাদীসের কিতাব সমূহের মধ্যে একমাত্র বায়হাকী শু’আবুল ঈমান গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি তিনি এভাবে উল্লেখ করেছেন। ইব্রাহীম (র) আলী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূল (স) কে শা’বানের মধ্য রাত্রিতে নামাজরত অবস্থায় দেখেছি, তিনি ১৪রাকাত নামাজ পড়লেন, অতঃপর নামাজ শেষে বসলেন, সূরা ফাতিহা ১৪বার পাঠ করলেন, সূরা ইখলাছ ১৪বার পাঠ করলেন, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ১৪বার পাঠ করলেন, আয়াতুল কুরসী ১বার পাঠ করলেন, সূরা তাওবার ১২৮নং আয়াত পাঠ করলেন, যখন তিনি তাঁর নামায শেষ করলেন, আমি তাঁর থেকে কৃত বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এভাবে করবে, তার জন্য ২০বার কবুল হওয়া হজ্জ, ২০বছর কবুল হওয়া রোযার ছওয়া আছে। আর যদি ঐ দিন রোযা রাখে, সে অতীতের দুই বছর ও সামনে এক বছরের রোযার ছওয়াব পাবে- শু’আবুল ঈমান ৩৫৫৯।

এবার আমরা দেখবো, তিনি ঐ হাদীসটি বর্ণনা করার পর কি বলেছেন, ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, হাদীসটি বানোয়াট হাদীসের সাদৃশ্য রাখে, এটি পরিত্যাজ্য, উসমান বিন সাঈদ অজ্ঞাত রাবী, আল্লাহই ভাল জানেন- শু’আবুল ঈমান ৩৫৫৯। ইবনে জাওযী ঐ হাদীসকে বানোয়াট হাদীসের মধ্যে গণ্য করেছেন- মাউযূ আতে ইবনে জাউযী খ ২-পৃ ১৩০, তানযীহিশ শারিআহ খ ২- পৃ ৯৪, আল আছারুল মারফূআহ খ ১- পৃ ৮০।

মূল কথা হচ্ছে, কুরআন ও হাদীসের কোথাও উপরোক্ত পদ্ধতিতে কোন ইবাদাতের বর্ণনা আসেনি। ফলে তৎকালীন যুগে প্রচলিত নিয়মটি নিয়ে মুসলিম উম্মাহ বেদাতে লিপ্ত হবে বলেই উক্ত বর্ণনাটি করার পর হাদীসটি কি আসলে আমলযোগ্য না বানোয়াট, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

আসুন, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী নিজেদের ঈমান ও আমলকে সাজিয়ে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করি। সকল প্রকার শিরক ও বেদাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে আল্লাহ ও রাসূল (স) এর অভিশম্পাত থেকে বেঁচে থাকি। ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বুঝে নিজেদের ঈমান ও আমল সাজানোর পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করতে অন্যের নিকট পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ, আমাদের সকলকে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ বুঝার তাওফিক দিন।

লেখক: হাফেজ মৌলানা ক্বারী মোহাম্মদ তৈয়ব জালাল
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক
একাডেমিক প্রধান: দারুস্সালাম একাডেমী।